শীতলক্ষ্যার তীরে পা ভিজিয়ে বসে আছেন মুন্সিগঞ্জের ইসলামপুর এলাকার বাসিন্দা রোকসানা আক্তার। নিজের চোখেই দেখেছেন ডুবে যাওয়া লঞ্চের উদ্ধার অভিযান। কিন্তু সন্ধান মেলেনি তার ছোট ভাই তানভীর ইসলামের। বার বার ইচ্ছে করছে লঞ্চের কাছে গিয়ে দেখতে।
কিন্তু এপাড় থেকে কোনো ট্রলারকেই আসা যাওয়া করতে দিচ্ছে না উদ্ধারকারী দল। শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত নৌকাতেই যাতায়াত করার সুযোগ আছে। কয়েকবার পুলিশ সদস্যদের কাছে অনুরোধ করলেও তারা এখানেই থাকার অনুরোধ করেছেন।সোমবার (৫ এপ্রিল) দুপুরে শীতলক্ষ্যার তীরে অসংখ্য স্বজনদের মতো বসে ছিলেন রোকসানা।
সবার থেকে একটু ব্যতিক্রম ছিলেন তিনি। অন্যান্যদের মতো আহাজারি কিংবা পুলিশের কাছে বার বার ছুটে না গিয়ে চুপচাপ বসে আছেন নদীর তীরে। শীতলক্ষ্যার নোংরা কালো পানিতে রেখেছেন পা ভিজিয়ে। যেন শরীরের ভেতর জ্বলতে থাকা বিষাদের আগুণ শীতলক্ষ্যার শীতল পানিতে ঠাণ্ডা করে নিচ্ছেন। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন কেবল।ছোট ভাই তানভীর ইসলাম (১৯) মুন্সিগঞ্জের ইসলামপুর এলাকার বাসিন্দা। মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার মধ্যেই এর অবস্থান। সবে মাত্র এসএসসি শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছেন তিনি। মুন্সিগঞ্জের স্থানীয় একটি কলেজে শুরু করেছেন পড়াশোনা।
সোমবার লকডাউন হবে দেশজুড়ে। এরপর ঘোরাঘুরি সব বন্ধ। কৈশোরের দুরন্তপনার কারণে লঞ্চে চড়ে এসেছিলেন নারায়ণগঞ্জে। লঞ্চে মাত্র দেড় ঘণ্টার পথ। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে আবারও লঞ্চে উঠেন। কিন্তু বাড়িতে আর ফিরেন নি তানভীর।রোকসানা জানান, টিভিতে লঞ্চ ডোবার খবর পেয়ে ভাবতেই পারেন নি তার ভাই এই লঞ্চে থাকতে পারেন। কিন্তু রাত বাড়তেই ভাইয়ের ফোন বন্ধ এবং খোঁজ না পাওয়ায় অজানা শঙ্কায় ছুটে আসেন নারায়ণগঞ্জে।
রাত ৩টায় এসে পৌঁছান নদীর তীরে। তারপর থেকে কেবল অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তিনি। জীবিত বা মৃত, কোনো একভাবে নিজের ছোট ভাইকে শেষবারের মতো দেখতে চান। ভাইটাকে বুকে জড়িয়ে ফিরতে চান নিজ বাড়িতে।প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা শেষ করতেই বাড়ি থেকে ফোন আসে, ওপাশ থেকে সন্ধান মিলেছি কি না এমন প্রশ্নের জবাবে গুমরে উঠে চেপে থাকা কান্না। বলেন, ‘আমার ভাইডারে পাইনাই গো… ভাইডারে পাইনাই…।’
গত রোববার বিকেলে যাত্রীবাহী লঞ্চ ‘সাবিত আল হাসান’ নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে যাত্রীবাহী লঞ্চটি কয়লাঘাট এলাকায় নির্মাণাধীন শীতলক্ষ্যা সেতুর নিচে এলে এসকে-৩ নামের একটি কোস্টার জাহাজ তাকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেয়।
সোমবার বেলা সাড়ে ১২ টায় ডুবে যাওয়া লঞ্চ ‘সাবিত আল হাসান’কে উদ্ধার করে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয়। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, কোস্ট গার্ড ও নৌ বাহিনীর সম্মিলিত অভিযানে ১৯ ঘণ্টা পর শেষ হয়েছে উদ্ধার অভিযান। অভিযানে ২৭টি মরদেহ উদ্ধার করেন তারা। নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে প্রাথমিক অনুদান প্রদান করছে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন।