অতীতের সব সরকার পাটকল বন্ধের উদ্যোগ নিলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি

অতীতের সব সরকার পাটকে লোকসানের খাত আখ্যা দিয়ে বন্ধের জন্য উদ্যোগ নিলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ১৯৯০ সালের পর যখন উদ্যোগ নেয়া হয় তখন রাজনৈতিক কারণে সব সরকার পিছু হটে। তবে আদমজী জুটমিলসহ বেশ কয়েকটি পাটকল বন্ধ করে দেয় বিএনপি সরকার। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বন্ধ পাটকলগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি চালু করে পাট খাতকে লাভজনক করার জন্য নানা উদ্যোগ নেয়।

২০১৭-১৮ সালে সরকার জানিয়েছিল, বিশ্বব্যাপী পাটের বহুবিধ ব্যবহার অনেক বেড়েছে। পাটের কদর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ সকল সমৃদ্ধ দেশে বেড়েছে। বিলেতে রাণীর ভবনেও পাটের তৈরি পণ্য ব্যবহৃত হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে পাটের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। দেশে পাটের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারের নেয়া বহুমুখী উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে-এ খাতে গবেষণা বাড়ানো, নতুন পাটনীতি প্রণয়ন, জুটমিল কর্পোরেশন সংস্কার এবং পণ্যের ব্যবহারে পলিথিনের ওপর ইকো ট্যাক্স আরোপ। এ ছাড়াও পাটের গুরুত্ব তুলে ধরতে ৬ মার্চ সারা দেশে জাতীয় পাট দিবস পালন করে আসছে। ফলে পাট খাতে বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।

২০১৩ সালে দেশীয় পাটের জন্মরহস্য আবিষ্কার করেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। ফলে জীবাণু প্রতিরোধক পাট উৎপাদন করার সম্ভাবনা তৈরি হয়। পাশাপাশি দেশি পাট দিয়ে বস্ত্রশিল্পের উপযোগী সুতা উৎপাদন করাও সম্ভব।


১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন ও পরিত্যক্ত পাটকলসহ সাবেক ইপিআইডিসির ৬৭টি পাটকল তদারক, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বিজেএমসি গঠিত হয়। পরে আরো পাটকল সরকারি করে বিজেএমসির আওতায় আনা হয় মোট ৮২টি পাটকল। কিন্তু ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ৪৩টি পাটকলকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার পর সরকারের হাতে থাকে ৩৮টি পাটকল। ১৯৯৩ সালে বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে পাট খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় আরো ১১টি পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়।


এশিয়ার বৃহত্তম আদমজী জুট মিল বন্ধ হয়ে যায় বিএনপি সরকারের আমলে, ২০০২ সালে। ‘অজগর’ আখ্যা দিয়ে বন্ধ করা হয় আদমজী। পাটশিল্পকে ‘সানসেট ইন্ডাস্ট্রি আখ্যা দিয়ে একে বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়। একের পর এক কারখানা বন্ধ হতে হতে বর্তমানে বিজিএমসির পাটকলের সংখ্যা ৩২। এর মধ্যে চালু রয়েছে ২৫টি, মামলা এবং বিচারাধীন ৫টি, ১টি নিয়ে বিক্রয়োত্তর মামলা, একটিতে ভিসকস উৎপাদন প্রকল্প নেয়া হয়েছে।


রাষ্ট্রীয় পাটকল বন্ধ করলেও বেসরকারি পাটকল কিন্তু বাড়ছে। বর্তমানে বেসরকারি পাটকলের সংখ্যা ২৮৫। মিলগুলোতে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ২ লাখের বেশি। বিজেএমসির অধীন ২৬টি পাটকলের মধ্যে বর্তমানে চালু আছে ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও তিনটি ননজুট কারখানা। ঢাকা অঞ্চলে সাতটি, চট্টগ্রামে ১০টি ও খুলনা অঞ্চলে নয়টি পাটকল রয়েছে। পাটকলগুলোতে বর্তমানে স্থায়ী শ্রমিক আছেন ২৪ হাজার ৮৫৫ জন। এছাড়া তালিকাভুক্ত বদলি ও দৈনিকভিত্তিক শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। তবে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় থাকবেন কেবল স্থায়ী শ্রমিকরা। এছাড়া কর্মচারীদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।


রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশই ছিল পাটের অবদান। বর্তমানে রফতানি খাতে পাটের অবদান ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। এ হার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হলেও দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পাটের রফতানি বাড়ানো যায়নি। গত বছরের জুলাই থেকে পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি কমেছে ২০ শতাংশের বেশি।


বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট মিল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সচিব এ বারিক খান বলেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পাটের রফতানি বাড়ানো যায়নি। গত বছরের জুলাই থেকে পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি কমেছে ২০ শতাংশের বেশি। এ সময়ে দুই হাজার ৯১২ কোটি টাকার রফতানি লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ২৮ শতাংশ পূরণ হয়নি। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কাঁচাপাটের রফতানি কমেছে ৬১ শতাংশ, পাটের সুতা ২৩ শতাংশ ও অন্যান্য পাটপণ্য ৫৪ শতাংশ। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে এ হার বেড়েছে।


তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে পাটকলের সংখ্যা জুট স্পিনিং মিলসহ সব মিলিয়ে ২২২টি। সবগুলোই চলছে ভালো। সরকারের পক্ষ থেকে ২০ শতাংশ রফতানি প্রণোদনা পেয়ে খুবই খুশি বেসরকারি পাটকল মালিকরা। কিন্তু সরকারি পাটকলগুলোতে এর কোনো প্রতিফলন নেই।
রাষ্ট্রের মালিকানায় থাকা জুটমিলগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ জুটমিলস ঘোড়াশাল, পলাশ, নরসিংদী; বাগদাদ-ঢাকা-কার্পেট ফ্যাক্টরি, নর্থ কাট্টলী, চট্টগ্রাম; করিম জুটমিলস, ডেমরা, ঢাকা; কেএফডি, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম; লতিফ বাওয়ানী জুটমিলস, ডেমরা ঢাকা; কার্পেটিং জুটমিলস, রাজঘাট, নোয়াপাড়া, যশোর; ইউএমসি জুটমিলস, নরসিংদী; যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ, রাজঘাট, নোয়াপাড়া, যশোর; রাজশাহী জুটমিলস, শ্যামপুর, রাজশাহী; ইস্টার্ন জুটমিলস, আটরা শিল্প এলাকা, খুলনা; জাতীয় জুটমিলস, রায়পুর, সিরাজগঞ্জ; আলীম জুটমিলস, আটরা শিল্প এলাকা, খুলনা; আমিন জুটমিলস ও ওল্ড ফিল্ডস, ষোল শহর, চট্টগ্রাম; ক্রিসেন্ট জুটমিলস, টাউন খালিশপুর, খুলনা; গুল আহমদ জুটমিলস, কুমিরা, বাড়বকুন্ড, চট্টগ্রাম; প্লাটিনাম জুবিলি জুটমিলস, টাউন খালিশপুর, খুলনা; হাফিজ জুটমিলস, বার আউলিয়া, চট্টগ্রাম; খালিশপুর জুটমিলস, টাউন খালিশপুর, খুলনা; এম এম জুটমিলস, বাঁশবাড়িয়া, চট্টগ্রাম; দৌলতপুর জুটমিলস, টাউন খালিশপুর, খুলনা; আর আর জুটমিলস, বাঁশবাড়িয়া, চট্টগ্রাম; স্টার জুটমিলস, চন্দনী মহল, খুলনা।


নন-জুট মিলগুলো হলো- জুটো ফাইবার গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ; গালফ্রা হাবিব, নাসিরাবাদ, চট্টগ্রাম; মিলস ফার্নিসিং, নাসিরাবাদ, চট্টগ্রাম। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল এই মুহূর্তে বন্ধ রয়েছে। সেটি হলো মনোয়ার জুটমিলস, সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।