করোনাকালে মানুষ যখন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত সেই সময়েও থেমে নেই নৃশংসতা

নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জে ব্যবসায়ীকে হত্যার পর ড্রামে ভরে সিমেন্ট ঢালাই করে গুম করে ফেলার মতো ঘটনা আতঙ্কিত জেলার বাসিন্দারা। প্রশ্ন উঠেছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। করোনাকালে মানুষ যখন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত এবং ঘুরে দাঁড়াবার পথ খুঁজছে সেই সময়েও থেমে নেই নৃশংসতা।

গত এক মাসে ঘটে যাওয়া মাসে খুনের ঘটনার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৭টি হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে। এদের মধ্যে ৪টি হত্যা অপেশাদার ব্যক্তির দ্বারা সংগঠিত হয়েছে। বাকি ৩টি হত্যা নিয়ে রয়ে গেছে ধোঁয়াশা। এসকল ঘটনার মধ্যে রয়েছে রূপগঞ্জে গণপিটুনিতে ডাকাতের মৃত্যু, শীতলক্ষ্যা নদীতে অজ্ঞাত বৃদ্ধের ভাসমান মরদেহ ও গৃহবঁধুর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা।

অপেশাদার খুনীদের হাতে এমন জঘন্য চিত্র ভীতির সঞ্চার করেছে মানুষের মনে। মনোবিদরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধের ঘাটতির কারণেই ঘটে চলেছে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড।

২ জুলাই রূপগঞ্জের কুশাবো এলাকা থেকে অপহরণের ৩ মাস পর নিখোঁজ ব্যবসায়ী হেকমত আলীর মরদেহ উদ্ধার করে পিবিআই। খুনিরা মরদেহটি ড্রামের ভেতরে সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করে পানিতে ফেলে দেয়। প্রায় ৮৮ দিন নিখোঁজ থাকার পর ক্লুলেস মামলার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয় পুলিশ। হত্যাকারী রফিকুল ইসলামের স্বীকারোক্তি ও দেখানো তথ্য মোতাবেল উপজেলার কুশাবো এলাকার একটি জলাশয় থেকে ড্রামটি উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যাকারী রফিকুল তারই আত্মীয় ও ব্যবসায়ী হেকমত আলীর মোটর পার্টসের দোকানে ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিল। ব্যবসার অর্থ আত্মসাৎ করার লক্ষ্যেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।

গত ৪ এপ্রিল হেকমত আলী তার রফিকুল ইসলামের বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে বাড়ি থেকে বের হন। সেদিন থেকেই সে নিখোঁজ ছিলেন। নিখোঁজের ১০ দিন পর ১৪ এপ্রিল হেকমত আলীর স্ত্রী রোকসানা বেগম বাদী হয়ে ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম সহ ৪ জনকে আসামি করে রূপগঞ্জ থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন। মামলাটির প্রথমে তদন্তের দায়িত্ব পান রূপগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম। এই মামলায় রফিকুলকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হন।

মামলাটি ১৮ জুন পিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। পিবিআই রফিকুল ইসলামকে রিমান্ডে নিলে বেরিয়ে আসে হত্যার লোমহর্ষক ঘটনার। হেকমত আলীকে রফিকুল ও তার সহযোগীরা হত্যা করে। পর তার মরদেহ তেলের ড্রামে ঢুকিয়ে ড্রামটি সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করে কুশাবো এলাকার জলাশয়ে ফেলে দেয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে রফিকুলের দেখানো মতে সেই পুকুর থেকে ঢালাই করা ড্রামটি উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতের পাঞ্জাবি ও পড়নের কাপড় দেখে বাদী রোকসানা ও পরিবারের সদস্যরা পরিচয় নিশ্চিত করে।

হত্যার পেছনে আর্থিক লেনদেন ঘটিত ব্যাপার ছিল তা নিশ্চিত করে হেকমত আলীর স্ত্রী রোকসানা আক্তার জানান, দোকানের ম্যানেজারের দায়িত্ব পাবার পর ব্যবসার টাকা পয়সা নিয়ে তার স্বামীর সাথে প্রায়ই রফিকুলের ঝামেলা হতো। দোকান ও তার অর্থসম্পত্তি আত্মসাতের জন্যই সে পরিকল্পিত ভাবে ডেকে নিয়ে হত্যা করে।

শুধু রূপগঞ্জের ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ নয়। গত ১ মাসে অপেশাদার খুনীদের হাতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে আরও ৩টি। এর ভেতর বন্দরে ২টি এবং ফতুল্লায় ১টি হত্যার ঘটনা ঘটে। কাকতালীয় হলেও এই ৩টি ঘটনা ঘটে একই দিনের।

গত ১২ জুন বন্দরের আমিরাবাদ এলাকায় যৌতুকের জন্য সোনিয়া আক্তার তামান্না (২০) নামে এক গৃহবধূকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ ওঠে স্বামীর বিরুদ্ধে। মৃত্যুর মাত্র ৮ মাস পূর্বে প্রেমের মাধ্যমে বিয়ে হলেও সেই সুখ বেশিদিন টেকেনি। মৃত্যুর ২ দিন পূর্বে ভুক্তভোগী তামান্না তার ভাইকে ফোন করে যৌতুকের দাবি ও নির্যাতনের কথা জানায়। দাবি করা যৌতুক না দিলে তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে মেরে ফেলবে বলেও মোবাইলফোনে ভাইকে জানায় তামান্না। ঠিক এর ২দিন পরেই তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তবে নিহতের শ্বশুরবাড়ির লোকজন এটিকে আত্মহত্যা বলে ধামাচাপে দেয়ার চেষ্টা চালায়।

একই দিন শহরের ফতুল্লা জামতলা এলাকায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা বকেয়া ভাড়া না পাওয়ায় ভাড়াটিয়াকে পিটিয়ে হত্যা করে নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবলীগ নেতার বাবা শাজাহান। নির্মম নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেন ৬৫ বছরের বৃদ্ধ ভাড়াটিয়া সিরাজুল ইসলাম। বৃদ্ধের মৃত্যুর পর থেকেই অভিযুক্ত শাজাহান পলাতক রয়েছেন। এ ঘটনার মামলা দায়ের করার পর ২৭ দিন পেরিয়ে গেলেও যুবলীগ নেতা শাহ ফয়েজ উল্লাহ ফয়েজের বাবাকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

নিহতের স্বজনরা জানান, বাড়ির বিদ্যুৎ বিল বাবদ বকেয়া সাড়ে তিন হাজার টাকা পরিশোধ না করায় সিরাজুল ইসলামকে পিটিয়ে আহত করে শাহজাহান। আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তাররা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতে বলে। সেদিন রাত থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। পরদিন বিকেলে তার মৃত্যু হয়।

সকাল ও বিকেলে দুটি মৃত্যুর খবর আসতেই রাতে বন্দর আমিন আবাসিক এলাকায় কিশোর গ্যাং কালচারের বলি হয় স্কুল ছাত্র অমিত। পূর্ব বিরোধের জের ধরে অমিত এবং তার ২ বন্ধুর উপর হামলা চালায় স্থানীয় কিশোর গ্যাং সদস্যরা। রাতে নদীর পাড়ে আড্ডা দেয়ার সময় তার উপর লাঠিসোঁটা নিয়ে আক্রমণ করে শাহপরান, শাকিল, সঞ্জয়, সোহেল, ফয়সাল, শুভ, সানী, সোহাগসহ অজ্ঞাত নামা ১৪/১৫ জনের একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। হামলা থেকে বাঁচতে নদীতে ভেড়ানো একটি বাল্কহেডের উপর উঠলে সেখানেও তাদেরকে পিটিয়ে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। সাঁতরে অমিতের ২ বন্ধু তীরে উঠতে পারলেও স্রোতে তলিয়ে যায় অমিত।