চালের বাজার স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হবে

এবার বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হলেও মিল মালিকরা চুক্তিমূল্যে সরকারকে চাল সরবরাহ করছিলেন না। চালকল মালিকরা সরকারকে চাল না দিলে প্রয়োজনে আমদানি করা হবে বলে বেশ কিছু দিন ধরেই তাদের হুঁশিয়ার করে আসছিলেন খাদ্যমন্ত্রী। এর পরও তেমন ফায়দা না হওয়ায় অবশেষে শুল্ক কমিয়ে বিদেশ থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মিল মালিকরা চুক্তিমূল্যে সরকারকে চাল সরবরাহ না করায় শেষ পর্যন্ত এমন সিদ্ধান্ত নিতে হলো সরকারকে।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারকে উদ্ধৃত করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা সুমন মেহেদি মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘চালের বাজার স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে আমদানি শুল্ক কমিয়ে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হবে।’ চলতি বছর সাড়ে ১৯ লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান-চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে সরকার। সে অনুযায়ী ৩৬ টাকা কেজি দরে মিলারদের কাছ থেকে ১০ লাখ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল, ৩৫ টাকা কেজিতে দেড় লাখ মেট্রিক টন আতপ চাল এবং সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ২৬ টাকা কেজিতে আট লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান কেনার কথা ছিল।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, চলমান করোনা পরিস্থিতিতে কিছু মিল মালিক ৩৬ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ করতে গরিমসি করে সরকারের কাছে চালের দাম বাড়ানোর দাবি তোলেন। অনেক মিল মালিক এখন চুক্তিমূল্যে চাল না দেয়ায় মজুদের লক্ষ্য পূরণ করা নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার।

এর আগে গত ১ জুলাই খাদ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘অপচেষ্টার মাধ্যমে চালের বাজার অস্থিতিশীল করা হলে কঠোর অবস্থানে যাবে সরকার। প্রয়োজনে চাল আমদানি করা হবে।’

চালকল মালিক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে ওই দিন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছিলেন, ‘এবার বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে; এই ভরা মৌসুমে চালের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার কোনো কারণ নেই। যদি কেউ অপচেষ্টার মাধ্যমে চালের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে তাহলে কঠোর অবস্থানে যাবে সরকার।’

চালকল মালিকদের উদ্দেশে খাদ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘চালের বাজার স্থিতিশীল রাখেন, সরকারের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ করেন; যদি তা না করেন তাহলে সরকার চাল আমদানিতে যেতে বাধ্য হবে। কিন্তু সরকার আমদানিতে যেতে চায় না; গেলে মিলারদের লোকসান হবে এবং যেসব কৃষক ধান ধরে রেখেছেন তারাও লোকসানে পড়বেন।’ খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার নিজেও পারিবারিকভাবে চাল ব্যবসায় যুক্ত, ফলে এর নাড়িনক্ষত্র তিনি ভালোই জানেন।

মিলগেট থেকে কোন ধান কত দামে বিক্রি হচ্ছে তা যাচাইয়ের পাশাপাশি তদারকির ব্যবস্থা নিতে বিভাগীয় কমিশনারদের নির্দেশ দেন খাদ্যমন্ত্রী। এই সময়ে যেসব মিল এগিয়ে আসবে তাদের ‘এ’ ‘বি’ ‘সি’ ক্যাটাগরিসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করার জন্য ইতোমধ্যেই খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেসব মিলকে পরবর্তী সময়ে সেভাবে মূল্যায়ন করা হবে। খাদ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সরকার ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিচ্ছে, সেই প্রণোদনার অংশীদারীর সুযোগ আপনারাও নিতে পারবেন। কোনোভাবেই সরকারিভাবে সংগ্রহের চালের মূল্য বৃদ্ধি করা হবে না।’

মন্ত্রীর এই আহ্বানের পরও বাজারে চালের দাম বাড়তে থাকে। ছোট ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মিল মালিক ও বড় ব্যবসায়ীরা তাদের কারসাজি চালিয়ে যাচ্ছেন, চালের দাম বেড়েছে সে কারণেই।

২০১৭ সালে হাওরে বন্যার সময় সরকারিভাবে চালের সংগ্রহ বাধাগ্রস্ত হলে সরকার চাল আমদানির ওপর ট্যাক্স ফ্রি করে দিয়েছিল। ফলে ৪০ লাখ মেট্রিক টন চাল বিভিন্নভাবে আমদানি করা হয়। এতে ওই বছর মিল মালিকরা এবং কৃষক উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

মিলারদের উদ্দেশে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এই করোনাকালে সবাই বিপদগ্রস্ত। এবার না হয় লাভ একটু কম করলেন। প্রত্যেকবার লাভ সমান হয় না। এবার মানুষকে সেবা করার সুযোগ রয়েছে, সেবার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসুন। যেহেতু খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে আপনাদের ব্যবসা সব সময় করতে হবে, তাই লাভ বেশি হলে চাল সরবরাহ করবেন, লাভ কম হলে সরবরাহ করবেন নাÑএটা হতে পারে না।’

মন্ত্রী বলেন, ‘কৃষক বাঁচলে ধান উৎপাদিত হবে এবং আপনারা চালকল মালিকরা বেঁচে থাকবেন। কৃষক যাতে বিপাকে না পড়ে, বিশেষ করে প্রান্তিক কৃষক যেন ধানের ন্যায্য মূল্য পায় সে জন্য এবার আট লাখ মেট্রিক টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই কৃষক তার ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে।’

সবাই দুষছে মিল মালিকদের: অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে ফের বেড়ে গেছে সব ধরনের চালের দাম। তবে এবারের বাজেটে চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সরবরাহ পর্যায়ে উৎসে কর হার কমানো হয়েছে। এছাড়া বোরোর বাম্পার ফলনে পর্যাপ্ত পরিমাণ ধানের মজুদ রয়েছে দেশে। সরকারি খাদ্যগুদামেও চালের কোনো সংকট নেই। কিন্তু ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে বাজারে চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। কষ্ট বাড়ছে খেটে খাওয়া গরিব মানুষের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিল মালিকদের কারসাজিতে বাড়ছে চালের দাম। দেশে করোনার শুরুতে গত মার্চ মাসে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে খোলাবাজারে ১০ টাকায় চাল বিক্রি, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালু এবং টিসিবির কার্যক্রম জোরদার করায় চালের দাম কমে আসে। কিন্তু স¤প্রতি ধানের দাম বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে এক সপ্তাহের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) দাম বাড়ানো হয়েছে ১৫০-২৫০ টাকা। ফলে রাজধানীসহ সারা দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে বাড়ছে চালের দাম।

রাজধানীর কাওরানবাজার ও বাদামতলীর পাইকারি চাল ব্যবসায়ীরা মিল মালিকদের দুষছেন। মিল মালিকরা বলছেন তাদের কাছে চাল নেই। চাহিদামতো অর্ডার করলে চাল দেয়া যাবে না। তবে পরক্ষণেই তারা একটি রেট (দাম) জানিয়ে দেয়। বলে এই দামেই নিতে হবে। কারণ ধানের দাম বেশি। এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, খাদ্যশস্যের এ মজুদ সন্তোষজনক। এ ছাড়া এ মুহূর্তে খাদ্যশস্যের কোনো ঘাটতি নেই। আন্তর্জাতিক বাজারেও দাম কম।

করোনা ভাইরাসের প্রকোপ না কমার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফের লকডাউন হচ্ছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার কারণেও চাল বিক্রি কিছুটা বেড়ে গেছে, এতে দামও বাড়ে। এবার বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুসারে চলতি বোরো মৌসুমে দেশে মোট ৪৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। যার মধ্যে ৯ লাখ হেক্টরে হাইব্রিড, ৩৮ লাখ ২০ হাজার হেক্টরে উফশী ও ২৯ হাজার হেক্টরে স্থানীয় জাতের বোরো আবাদ করা হয়।

অন্যদিকে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় হেক্টর প্রতি গড়ে ৪ দশমিক ২০ টন করে মোট দুই কোটি লাখ টন। পরিসংখ্যান অনুসারে দেখা যায়, আগের কমপক্ষে তিন বছরে ধারাবাহিকভাবে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। আর এবারের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও ছিল গত বছরের কাছাকাছি।

রাজধানীর কাপ্তানবাজারের চাল ব্যবসায়ী নুরু মিয়া বলেন, ‘প্রথম দিকে নতুন চালের দাম কম থাকায় আমাদের আগের চাল কেনা দামে বিক্রি করে দেই। কিন্তু কয়েক দিন ধরে আবার চালের দাম বেড়ে গেছে। বাজারে চালের যে চাহিদা সরবরাহ তার তুলনায় কম, এ কারণে হয়তো দাম বেড়ে গেছে।’ তিনি বলেন, সরবরাহ বাড়লে আবার চালের দাম কমবে। ঢাকার মিরপুর শাহ আলী মার্কেটে চালের পাইকার মহিউদ্দিন হারুন বলেন, ‘নতুন ধান ওঠার পর প্রায় ১০ দিনের মতো চালের দাম কমেছিল। এক মাস ধরে দাম হু হু করে বাড়ছে।’

নওগাঁর আরএম রাইস মিলের মালিক জেলা চালকল সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, এক মাস আগে চালের দাম বেশ কম ছিল। মাঝখানে ধানের দাম বাড়ার পর চালে দাম কিছুটা বেড়েছে। তিনি বলেন, তারা মিল গেটে মিনিকেটের বস্তা ২৪৫০ টাকা করে বিক্রি করছেন, যা আগে ছিল ২৩০০ টাকা।

কুষ্টিয়া জেলা চালকল সমিতির সভাপতি (একাংশ) ও সরনা রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী আব্দুস সামাদ জানান, এপ্রিল মাসে নতুন ধান ওঠার পর মিনিকেট চালের দাম মিল পর্যায়ে প্রতি কেজি ৪৪ টাকায় নেমেছিল। এখন দাম বেড়ে ৪৮ টাকায় উঠে গেছে।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি শহীদুল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, ‘এ বছর ধানের দাম অনেক বেড়েছে। ধানের দাম বাড়ার কারণে কৃষক ও কৃষিখাত উপকৃত হবে।

উড়োজাহাজ ব্র্যান্ড চালের উৎপাদক দিনাজপুরের আদর অ্যান্ড মমতা রাইস এজেন্সির পরিচালক শহীদুলের দাবি, ধানের দামের সঙ্গে সমন্বয় করেই চালের দাম বেড়েছে। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, ‘সরকার প্রতিমণ ১০৪০ টাকা ধানের দর বেঁধে দিয়েছে। সেই হিসাবে চালের দাম এখনো কমই আছে বা সঠিক পর্যায়ে আছে।’ তবে মিল মালিকরা ধানের দাম বেড়েছে বলে দাবি করলেও গতবারের চেয়ে দাম কত বেড়েছে সে প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারেননি।

তবে কৃষকরা যে এখনো সরকারের বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে অনেক কমে চালকল মালিকদের কাছে ধান সরবরাহ করছেন তা কুষ্টিয়ায় মিরপুরের আমলা গ্রামের কৃষক সুলাইমানের কথায় স্পষ্ট। তিনি বলেন, এবার তিনি ২০ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন। মিলারদের কাছে মণপ্রতি ধান বিক্রি করেছেন সাড়ে ৮০০ থেকে সাড়ে ৯০০ টাকায়।

দেশে চালের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে মিল মালিকরা দায়ী বলে অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রামের চাক্তাইয়ে আড়তদাররা। গত রবিবার জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের সময় তারা এ অভিযোগ করেন বলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক জানান। তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা এবং নারায়ণগঞ্জ ও আশুগঞ্জের বিভিন্ন মিল মালিকরা ‘কারসাজি’ করে চালের দাম বাড়িয়েছে, যার কারণে পাইকারি ও খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়ছে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বর্তমানে চালের দাম বাড়া অযৌক্তিক। দেশে চালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। আমন মৌসুমে ধানেরও বাম্পার ফলন হয়েছে। তাই সরকার ও সংশ্লিষ্টদের এর কারণ অনুসন্ধান করে দাম বাড়ানোর পেছনে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ ছাড়া দাম যেন আর না বাড়ে, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।