না’গঞ্জে হেফাজত নেতাদের অনেকেই অদৃশ্য ছায়ায় কোটিপতি!

এক সময়ে নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মুসলমান হেফাজতে ইসলামের প্রতি ছিলেন মারাত্মক অনুরক্ত। হেফাজতের কোন বয়ান, আহŸান আর বক্তব্য ইসলামের মূল ভিত্তির উপর এমনটাই ভাবতেন। সেই টানে ২০১৩ সালের মে মাসে নারায়ণগঞ্জ থেকে লাখো মানুষ পায়ে হেঁটে রাজধানীর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল। শহরের ডিআইটি এলাকায় স্মরণকালের বৃহত্তম সমাবেশ করে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছিল। লাখ লাখ টাকা মুসলমানেরা সঁপে দিয়েছিল হেফাজতের দান বাক্সে। দোর্দান্ড প্রতাপ নিয়ে চলা সেই হেফাজতে ইসলাম এখন মূল্যহীন। এক সময় নারায়ণগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের প্রচুর অনুরাগী থাকলেও এখন সেটা তলাবিহীন ঝুঁড়ির মত মূল্যহীন। জৌলুস হারিয়েছে হেফাজত।

সংশ্লিষ্টদের মতে, নারায়ণগঞ্জে এক সময়ের জনপ্রিয় ইসলামিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের প্রতি জনসমর্থন দিন দিন কমে গিয়ে আস্থাহীনতা দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আর দলীয় নেতাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে আঁতাত করে তাদের সুরে সুর মিলিয়ে চলা হেফাজতের প্রতি জনগণের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হচ্ছে। অনেকের ধারণা, ক্ষমতাসীনদের পক্ষে সরাসরি কাজ করার ফলে তাদের প্রতি মানুষের আস্থা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে হেফাজত এখন জনগণের কাছে একটি সুবিধাবাদী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীতে হেফাজতে ইসলামের শো ডাউনের পরদিন ৬ মে ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের শিমরাইলে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে হেফাজতে ইসলাম, স্থানীয় লোকজন ও হেফাজত লেবাসে থাকা জামায়াত শিবিরের ক্যাডারদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে টানা সাড়ে ৫ ঘণ্টার ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। তবে এর আগেই নারায়ণগঞ্জে নানা কারণে বেশ আলোচিত ছিল হেফাজতে ইসলাম।

জানা গেছে, ২০১৩ সালে নারায়ণগঞ্জে সমাবেশ, ১৩ দফা দাবীতে মহাসমাবেশ সহ, চাষাঢ়ায় রাজীব চত্বর ভাঙচুরসহ আরো কিছু ঘটনা ঘটিয়ে আলোচিত হয়ে উঠে হেফাজতে ইসলাম। কিন্তু গত ৭ বছরে ইসলামী আদর্শের নামে গড়া সংগঠনটি নানাভাবে বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। ইসলামিক সংগঠনের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে হেফাজতে ইসলাম প্রথম দিকে সাধারণ জনগণের জনপ্রিয়তা কুড়াতে সক্ষম হয়। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের ঘটনায় তা দেখা গেছে। সেখানে কওমী শিক্ষার্থীদের ঢল নেমেছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তারা ক্ষমতাসীন দলের সাথে ভিড়ে ক্ষমতার স্বপ্ন দেখতে থাকে। এমনকি নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামের সাথে গোপনে আঁতাত করে সংগঠনকে আরো শক্তিশালী করারর প্রচেষ্টাও দেখা গেছে। এতে তারা দিন দিন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে বলে মনে করেন সমর্থকরা। উলামা ইসলাম যে কমিটির নেতৃত্বে আবার হেফাজতে ইসলামের নেতারাও তাদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মাঈনউদ্দিন আহমদ। যিনি নাশকতা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামের নেতাকর্মীদের তাদের চারপাশে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে। এতে করে এই হেফাজতকে নিয়ে নানা সমলোচনার ঝড় উঠে।

সূত্র বলছে, ক্ষমতা হাসিলের লোভে হেফাজত একের পর এক ইসলামিক দলগুলোকে একত্রিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর সেই চেষ্টায় নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামও বাদ পড়েনি। তাই জামায়াতে ইসলাম প্রকাশ্যে আসতে না পারায় হেফাজতের মধ্য দিয়ে প্রকাশ্যে আসতে পারছে। আর বিভিন্ন স্বার্থের জন্য হেফাজতে ইসলাম তাদেরকে সুযোগ করে দিচ্ছে। তবে তাতেও ক্ষমতা হাসিলের ক্ষিদে যখন অপূর্ণ থেকে যায় তখন রাজনীতিক দলগুলো সাথে সখ্যতা বাড়াতে শুরু করে। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপল চত্বরে জনসমুদ্র তৈরি করেও সরকারকে টলাতে পারনি। সেই ঘটনা থেকে ক্ষমতা হাসিলের মরণ নেশা পেয়ে বসে হেফাজতকে। তাই ক্ষমতার পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্ষমতাসীনদের সাথে সরাসরি আঁতাত করে বসে সংগঠনটি। গত কয়েক বছরে নারায়ণগঞ্জ হেফাজতে ইসলামের ৩ থেকে ৪ জন নেতা বনে গেছেন অঢেল টাকার মালিক। কিনেছেন ফ্লাট আর গাড়ি। এসব নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটিও বিষয়টি নজরে এনেছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে নারায়ণগঞ্জের ৪ জন নেতার আমূল পরিবর্তনের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। সংগঠনের পরের শূরা কমিটিতে এ নিয়ে আলোচনা হতে যাচ্ছে।

বিগত কয়েক বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ জেলার হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যাচ্ছে। আর ওসমান পরিবারের সদস্যদের সুরে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন হেফাজত নেতারা। আর তাদের নির্দেশে বিভিন্ন কাজও করছেন অনায়াসে। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমানের সাথেও ওয়াজ মাহফিলসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হেফাজতের এসব নেতাদের দেখা যাচ্ছে। আর সেসব নেতারা ওয়াজে এমপি শামীম ওসমানের সুরে তাল মিলিয়ে কথা বলছেন। আর এমপি শামীম ওসমানের মৌন সমর্থন পেয়ে মহানগর হেফাজতের সমন্বয়ক মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান ধর্ম অবমাননার অভিযোগে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছিল। পরে অবশ্য সেই মামলা বেশি দূর এগোতে পারেনি। এদিকে একাদশ জাতীয় সাংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগ মুহুর্তে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে মহানগর হেফাজতে ইসলামের সমন্বয়ক মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন এক অনুষ্ঠানে। যদিও তার নির্বাচনী তোড়জোড় বেশি দিনে টিকেনি। অদৃশ্য মহলের নির্দেশে তিনি চুপসে যান।

জানা যায়, এমপি শামীম ওসমান ওই আসনে নির্বাচনের মনোনয়ন পাওয়ার আগে থেকেই কাজ করে যাচ্ছিলেন। মাওলানা ফেরদাউসুরের নির্বাচনের ঘোষণার প্রেক্ষিতে শামীম ওসমানের জন্য নির্বাচরী প্রচারণা কঠিন হয়ে পড়তে যাচ্ছিল। তাই স্বার্থের বিনিময়ে হেফাজতের এই নেতা চুপসে যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অরাজনৈতিক ক্লিন ইমেজধারী ইসলামিক সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হওয়া হেফাজতে ইসলাম নানা কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে বিগত দিনে বৈরিতার দৃশ্যপট তৈরি হলেও তাদের সাথে হেফাজতের বর্তমান সখ্যতার বিষয়টি জনগণের চোখে আঙুল দিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিলের বিষয়টি স্পষ্ট করছে। আর তাতে হেফাজতের জনপ্রিয়তা ধূলায় মিশে গিয়ে উল্টো জনগণের কাছে সমালোচিত হচ্ছে। কারণ ধর্মীয় আনুভূতিসম্পন্ন সাধারণ মানুষ যেমন খুব সহজে কাউকে বিশ্বাস করে ফেলে ঠিক তেমনি উল্টো চিত্র দেখে অবিশ্বাসও তাদের মাঝে তৈরি হয়েছে। যা তিক্ততার মধ্য দিয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এক সময়ের হেফাজতে ইসলাম সরকারের কঠোর সমালোচনা করলেও এখন তারা উল্টো তাদের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলছে। এতে করে এক অঙ্গে এতো রূপ জনসাধারণের কাছে বিতর্কিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই তারা ক্ষমতা হাসিলের লোভে জনসমর্থন হারাচ্ছে। ফলে ক্ষমতাসীন দল কোন কারনে ক্ষমতাচ্যুত হলে হেফাজতে ইসলাম বেকায়দায় পড়ে যাবে। আর তখন ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকবেনা।