আবারও পেঁয়াজের ‘পাগলা ঘোড়া’ খেপেছে

আবারও পেঁয়াজের ‘পাগলা ঘোড়া’ খেপেছে। ভারতের বাজারে দাম বাড়ার খবর, দেশে বন্যার অজুহাত ও আমদানিকারক ও পাইকারদের সিন্ডিকেটের কারণে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে পেঁয়াজের দাম আবার বেসামাল হয়ে পড়ছে। এক সপ্তাহ আগেও যেখানে পাইকারি দরে পাঁচ কেজি পরিমাণের পেঁয়াজ ১৫০ থেকে ১৭৫ টাকায় বিক্রি হতো এখন একই পরিমাণ পেঁয়াজ গতকাল পর্যন্ত ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

গত বছরের একই মাস সেপ্টেম্বরেই পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। গত বৃহস্পতিবার থেকে গতকাল পর্যন্ত ৪৫ টাকা কেজির দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়। ফলে আতঙ্কিত ভোক্তারা অনেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পেঁয়াজ কিনে মজুদ করছেন। গত বছরও সেপ্টেম্বর থেকে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। ৩০০ টাকা কেজির পেঁয়াজ খাওয়ার অভিজ্ঞতা এখনো ভোলেননি অনেকে।

রাজধানীর গোপীবাগে কেনাকাটা করতে আসা বেসরকারী কর্মকর্তা লোকমান হায়দার যায়যায়দিনকে বলেন, একদিকে করোনার পরিস্থিতিতে বেতন দশ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে আবার বাজারে পেঁয়াজ, সবজিসহ সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে নগরে টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়েছে।

পেঁয়াজের দাম বেড়েছিল গত সপ্তাহে। ভারতীয় পেঁয়াজের কেজি উঠেছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। আর দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। দুই দিন পরেই পাইকারি বাজারে দাম কমে যায়। খুচরায়ও কমে। দেশি পেঁয়াজ ৬০ টাকা আর ভারতীয় ৫০ টাকায় নামে। গত দুদিন ধরে দাম আবার বাড়তি। খুচরা বাজারে এখন প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৬৫-৭০ এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

তবে সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রনকারী সংস্থাগুলো বলছে, গত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা তৎপর রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে এবার আগে থেকেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। গত রবিবার সংশিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকও করা হয়েছে। বৈঠকে বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পেঁয়াজ আমদানিকারকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুল্কহার পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।

ব্যবসায়ীদের দাবি, করোনা ভাইরাসের কারণে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে না। এছাড়াও স্থানীয় বাজারে দাম বেড়েছে বন্যার কারণে। গত বছর দেশে পেঁয়াজের কেজি ৩০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। ভারত থেকে পেঁয়াজ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এবারও পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করে ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে। শেষ পর্যন্ত দাম কোথায় দিয়ে ঠেকে তা নিয়ে শঙ্কিত ক্রেতাসাধারণ। তবে, ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগামী অক্টোবরেই ভারতে নতুন মৌসুমের পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করবে। ফলে বাজার অস্থির হওয়ার সুযোগ নেই।

জানা গেছে, গত রবিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে টাস্কফোর্স কমিটির বৈঠক হয়। মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুদ রয়েছে, আমদানিও স্বাভাবিক রয়েছে। ফলে পেঁয়াজের সংকট বা দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। অবৈধ মজুত কিংবা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

টিসিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রতি মাসেই তারা খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করছে। এ মাসে বিক্রি শুরু হবে চলতি আগামী সপ্তাহ থেকে। নিয়মিত পণ্য তেল, চিনি, ডালের সঙ্গে পেঁয়াজও বিক্রি করা হবে।

দেশে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম ৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ৭০ টাকায় উঠে। পেঁয়াজের হঠাৎ করে মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ভারতের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে আমদানির চেয়ে বিক্রিতে পেঁয়াজের মূল্য বেশি রাখায় গত রবিবার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে বেশ কয়েকটি পেঁয়াজ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ কারণে সোমবার খাতুনগঞ্জের সব পেঁয়াজের আড়ত বন্ধ করে রেখেছিল ব্যবসায়ীরা।

কাওরানবাজারের ব্যবসায়ী আবদুল আলিম যায়যায়দিনকে বলেন, ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বাড়লে দেশি পেঁয়াজের দামও বাড়ে। তারা আমদানিকারক ও শ্যামবাজার থেকে পেঁয়াজ এনে কাওরানবাজারে বিক্রি করেন। সেখানে যে টাকায় পান তার সঙ্গে সামান্য লাভ যোগ করে পাইকারিতে বিক্রি করেন।

পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশে আমদানি করা পেঁয়াজের ৯৫ শতাংশ আসে ভারত থেকে। তবে ভারত থেকে আমদানিতে সমস্যা হলে অন্য দেশ থেকেও আমদানি করা হয়। সরকারি হিসেবে দেশে বর্তমানে ২৩ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। কিন্তু পেঁয়াজ ঘরে তোলার সময় প্রায় পাঁচ লাখ টন নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ ১৯ লাখ টন পেঁয়াজ বাজারে থাকে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে আমদানি হয় ১১ লাখ টন। কিন্তু প্রতিবছর ৩০ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ প্রয়োজন।

এদিকে ভারতের বাজারেও পেঁয়াজ কেজি প্রতি ১০ থেকে ২৪ রুপি বেড়েছে। তবে গত বছরের পুনরাবৃত্তি এবার হবে না বলেই আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।

আড়দার হামিকম আলী বলেছেন, এবার সেরকম কোনো সম্ভাবনা নেই। কাঁচাপণ্য, দুই-পাঁচ টাকা ওঠানামা করতে পারে। কিন্তু গত বছরের মতো দাম লাগাম ছাড়িয়ে যাবে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পেঁয়াজ উঠতে শুরু করলেই ভারতের বাজারে দাম কমবে, তখন দেশি পেঁয়াজের দামও কমে যাবে। অক্টোবর মাসেই ভারতের বাজারে নতুন পেঁয়াজ ওঠার কথা রয়েছে।

পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের আড়তমালিক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, পাইকারিতে কেজিপ্রতি দাম ৫ টাকার মতো বেড়ে ভারতীয় পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৪২ টাকা ও দেশি পেঁয়াজ ৫২ থেকে ৫৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মিয়ানমার ও পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানির চেষ্টা চলছে। এক সপ্তাহ পর ওই পেঁয়াজ এলেই দাম কমতে পারে।